ইন্টারনেট আবিষ্কারের কৃতিত্ব একজন ব্যক্তিকে দেওয়া অসম্ভব। ইন্টারনেট ছিল কয়েক ডজন অগ্রগামী বিজ্ঞানী, প্রোগ্রামার এবং প্রকৌশলীর কাজ, যারা প্রত্যেকেই নতুন বৈশিষ্ট্য এবং প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়েছেন, যা অবশেষে একত্রিত হয়ে “তথ্য সুপারহাইওয়ে” হয়ে উঠেছে। বর্তমানে এই সুপার হাইওয়ে ইন্টারনেট বলে পরিচিত। এছাড়াও, ইন্টারনেটের আবির্ভাব ছিল একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাই সরাসরি কোন নির্দিষ্ট তারিখকে ইন্টারনেটের আবিষ্কারের স্বীকৃতি দেয়া অন্যায় হবে।
শুরুর কথা
প্রকৃতপক্ষে ইন্টারনেট তৈরির প্রযুক্তি আসার অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন বিজ্ঞানী বিশ্বব্যাপী তথ্য নেটওয়ার্কের অস্তিত্বের স্বপ্ন দেখেছিলেন। নিকোলা টেসলা বিংশ শতকের গোড়ার দিকে একটি “ওয়ার্ল্ড ওয়্যারলেস সিস্টেম” এর ধারণা নিয়ে রিসার্চ করতেন। পল অটলেট এবং ভ্যানেভার বুশের মতো দূরদর্শী চিন্তাবিদরা ১৯৩০ এবং ১৯৪০ এর দশকে বই এবং মিডিয়ার যান্ত্রিক, অনুসন্ধানযোগ্য স্টোরেজ সিস্টেমের ধারণা করেছিলেন।
তবুও, ইন্টারনেটের জন্য প্রথম ব্যবহারিক স্কিম্যাটিক্স ১৯৬০ এর দশকের আগে দেখা যায়নি। এমআইটি-এর জেসিআর লিকলাইডার কম্পিউটারের একটি “ইন্টারগ্যাল্যাকটিক নেটওয়ার্ক” ধারণাকে এ সময় বিশ্বের সাথে পরিচিত করান। তার এই রূপরেখার ওপর ভিত্তি করে তখনকার কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা “প্যাকেট সুইচিং” ধারণাটি তৈরি করেন। এটি কার্যকরভাবে ইলেকট্রনিক ডেটা প্রেরণের প্রথম পদ্ধতি, যা পরবর্তীতে ইন্টারনেটের অন্যতম প্রধান বিল্ডিং ব্লক হয়ে ওঠে।
১৯৬৯ সালের ২৯ অক্টোবর, UCLA এর নেটওয়ার্ক মেজারমেন্ট সেন্টার, স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SRI), ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া-সান্তা বারবারা এবং ইউনিভার্সিটি অফ ইউটা নোড ইনস্টল করে। প্রথম বার্তাটি হল “LO”, যা ছাত্র চার্লস ক্লাইনের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে SRI কম্পিউটারে “LOGIN” করার একটি প্রচেষ্টা ছিল৷ যাই হোক, এসআরআই সিস্টেম ক্র্যাশ হওয়ার কারণে বার্তাটি সম্পূর্ণ করা যায়নি।
এখন প্রশ্ন থাকতে পারে, নোড আসলে কি?
ইন্টারনেট নোড হল নেটওয়ার্ক সংযোগ পয়েন্ট। প্রতিটি লাইন ইন্টারনেট ব্যাকবোনে দুটি নোডের মধ্যে একটি পথ উপস্থাপন করে।
১৯৭০র দশক
১৯৭২ সালে ইন্টারনেট সংক্রান্ত একটি যুগান্তকারী অগ্রগতি হয়। বিবিএন-এর রে টমলিনসন নেটওয়ার্ক ইমেল প্রবর্তন করেন। এর সাথে সাথে স্ট্যান্ডার্ড প্রোটোকল প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করার জন্য ইন্টারনেট ওয়ার্কিং গ্রুপ (আইএনডব্লিউজি) তাদের যাত্রা শুরু করে। এর পরের বছর ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডন (ইংল্যান্ড) এবং রয়্যাল রাডার এস্টাবলিশমেন্ট (নরওয়ে) ARPANET-এর সাথে সংযুক্ত হওয়ার পর গ্লোবাল নেটওয়ার্কিং-এর বাস্তবে রূপ নেয়, এবং প্রথমবারের মত ইন্টারনেট নামক শব্দটির জন্ম হয়। এর পরের বছর প্রথম ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী (ISP) ARPANET-এর একটি বাণিজ্যিক সংস্করণ টেলিনেট নামে তাদের যাত্রা শুরু করে।
১৯৭৪ সালে “প্যাকেট নেটওয়ার্ক ইন্টারকানেকশনের প্রোটোকল” আবিষ্কার হয়, যা কিনা ট্রান্সমিশন কন্ট্রোল প্রোটোকল (TCP) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে দেয়। ভিনটন সারফ এবং বব কান এটি আবিষ্কার করেন, তাই অনেকের মতে এই দুজনই ইন্টারনেটের জনক। ১৯৭৯ সালে সংবাদ এবং আলোচনা গ্রুপ হোস্ট করার জন্য USENET শুরু হয়, যা আরেকটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।
১৯৮০র দশক
১৯৮১ সালে ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন (NSF), বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানীদের নেটওয়ার্কিং পরিষেবা প্রদানের জন্য কম্পিউটার সায়েন্স নেটওয়ার্ক (CSNET) প্রতিষ্ঠার জন্য একটি অনুদান প্রদান করে।
পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে ট্রান্সমিশন কন্ট্রোল প্রোটোকল (TCP) এবং ইন্টারনেট প্রোটোকল (IP), ARPANET-এর প্রোটোকল হিসাবে আবির্ভূত হয়। TCP/IP ইন্টারনেটের জন্য স্ট্যান্ডার্ড প্রোটোকল হিসেবে এখনও টিকে রয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক ডোমেইন নেম সিস্টেম (DNS) আবির্ভুত হয় ১৯৮৩ সালে। .edu, .gov, .com, .mil, .org, .net এবং .int মাধ্যমে ডোমেইন নেম সিস্টেম বিখ্যাত হতে শুরু করে। Symbolics.com, ম্যাসাচুসেটসে সিম্বলিক্স কম্পিউটার কর্পোরেশনের ওয়েবসাইট, প্রথম নিবন্ধিত ডোমেনে পরিণত হয়।
১৯৮৭ সাল নাগাদ ইন্টারনেটে হোস্টের সংখ্যা 20,000 ছাড়িয়ে যায়। এবছরই সিসকো তার প্রথম রাউটার বাজারে নিয়ে আসে।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব
১৯৯০ সালে CERN-এর একজন বিজ্ঞানী টিম বার্নার্স-লি, হাইপারটেক্সট মার্কআপ ল্যাঙ্গুয়েজ (HTML) বিকাশ করেন। আমরা কীভাবে আজ ইন্টারনেট নেভিগেট করি এবং কীভাবে দেখি তার উপর এই প্রযুক্তির একটি বড় প্রভাব রয়েছে৷ এ কারণে টিম বার্নার্স-লি কেও অনেকে আধুনিক ইন্টারনেটের জনক হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। HTML জনপ্রিয় হওয়ার সাথে সাথে ইন্টারনেট এবং ওয়েবসাইট জনসাধারণের হাতের নাগালে আসতে থাকে। HTML এর মাধ্যমে অনেক নতুন ওয়েবসাইট তৈরি হতে থাকে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বাইরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট চালু হয়ে যায়।
এরপর থেকে আরও অনেক প্রোগ্রামার এবং গবেষক ইন্টারনেটের ব্যপ্তি বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন সংযোজন করেন। তবে আবিষ্কারের কথা বলতে গেলে, ৯০ এর দশক পর্যন্ত সময়কেই ইন্টারনেটের ‘আবিষ্কার’ সময়সীমা হিসাবে ধার্য করা উচিত। ১৯৯৫ সাল নাগাদ ইন্টারনেট একটি প্রচলিত বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে স্বীকৃত হয়।