পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক মুসলিম বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের জগতে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছেন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে তাদের অবদান আজও মহামূল্যবান হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বিভিন্ন যুগে মুসলিম বিজ্ঞানীরা উল্লেখযোগ্য সব ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছেন। আবিষ্কারের পাশাপাশি তারা অনেক কালজয়ী বিজ্ঞানের বই লিখেছেন, যা যুগে যুগে অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
যেসব ক্ষেত্রে মুসলিম বিজ্ঞানীরা মূল্যবান অবদান রেখেছেন, তার মধ্যে কয়েকটি হল: মেডিসিন, সার্জারি, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, দর্শন, জ্যোতিষশাস্ত্র, এবং জ্যামিতি।
শীর্ষ মুসলিম বিজ্ঞানীদের তালিকা
আজ আমরা ১০ জন শীর্ষ মুসলিম বিজ্ঞানী এবং তাদের অর্জনের উপর আলোকপাত করব।
ইবনে সিনা (৯৮০ – ১০৩৭)
অ্যাবেসেনা নামে বেশি পরিচিত, ইবনে সিনা একজন প্রখ্যাত পারস্য দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী। তিনি চিকিৎসাবিদ্যা এবং অ্যারিস্টটলীয় দর্শনের ক্ষেত্রে অপরিসীম অবদান রেখেছেন।
তিনি কিতাব আল-শিফা এবং আল-কানুন ফি আল-টিব নামে পরিচিত চিকিতসাবিজ্ঞানের বই রচনা করেন। কিতাব আল-শিফা হল একটি চার-অংশের বিশ্বকোষ, যা চিকিৎসাবিজ্ঞান ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়, যেমন যুক্তিবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, গণিত এবং অধিবিদ্যা সম্পর্কে তার জ্ঞানের পরিচয় দেয়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে তার অপরিসীম অবদানের কারণে মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার বইগুলোকে চিকিৎসার পাঠ্যবই হিসেবে ব্যবহার করত। তিনি ইসলামের স্বর্ণযুগের সবচেয়ে বিখ্যাত চিকিৎসক হিসেবেও ইতিহাসবিদদের কাছে পরিচিত।
আবু নসর আল-ফারাবী (৮৭০-৯৫০)
আবু নাসর আল-ফারাবি সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং রাজনৈতিক দর্শনের অগ্রগামী চিন্তাবিদ ছিলেন এবং মেটাফিজিক্স, রাজনৈতিক দর্শন এবং নীতিশাস্ত্রেও তার একটি বড় অবদান রয়েছে।
তাঁর বিখ্যাত বই হল কিতাব আল-মুসিকা আল-কবীর (দ্য গ্রেট বুক অফ মিউজিক), আল-মদিনা আল-ফাদিলা (দ্যা ভার্চুয়স সিটি), রিসালা ফি’ল-আকল (বুদ্ধির উপর পত্র), কিতাব আল-হুরুফ (বুক অফ লেটারস) এবং কিতাব ইহসা’আল-উলুম (বিজ্ঞানের গণনার বই)। তিনি প্লেটো ও এরিস্টটলের মতবাদ মুসলিম বিশ্বে সুপরিচিত করেন।
আলী ইবনে ঈসা আল-কাহাল (১০১০)
আলি ইবনে ঈসা আল-কাহলকে চক্ষুবিদ্যার জনক হিসেবে অনেকেই মেনে নেন। তার বিস্তৃত কাজের মধ্যে রয়েছে চোখের বিভিন্ন রোগ, তাদের চিকিৎসা এবং চোখের শারীরবৃত্তির চিত্র। তিনি সাধারণত মধ্যযুগীয় ইউরোপে জেসু অকাল্টিস্ট নামে পরিচিত ছিলেন।
তিনি মেমোরেন্ডাম অফ দ্য অকাল্টিস্টস বইটি লিখেছিলেন যা ছিল তার সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে। এই বইয়েই তিনি প্রথমবারের মতো অস্ত্রোপচারে চেতনানাশক ব্যবহার নিয়ে আলোকপাত করেন।
মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খোয়ারিজমি (৭৮০ – ৮৫০)
আল খোয়ারিজমি ছিলেন পারস্যের একজন প্রখ্যাত মুসলিম গণিতবিদ। তিনি সর্বপ্রথম গাণিতিক অপারেশন সমাধান করতে বীজগণিত ব্যবহার করেন। দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা সমাধানেও যে বীজগণিত কাজে লাগতে পারে, তা তিনিই প্রথম দেখিয়েছেন। তিনি শুধুমাত্র ১০টি সংখ্যা অর্থাৎ 0 থেকে ৯ (ভারতীয় ব্রাহ্মী সিস্টেম থেকে উদ্ভাবিত) ব্যবহার করে সংখ্যা পদ্ধতিতে একটি নির্দেশিকাও চালু করেছিলেন।
তিনি ত্রিকোণমিতি, ভূগোল এবং জ্যোতির্বিদ্যা ছাড়াও বীজগণিতীয় সমীকরণ এবং রৈখিক সমীকরণে অবদান রেখেছিলেন। তাকে বীজগণিতের জনক বলে মনে করা হয়।
আম্মার ইবনে আলী আল-মাওসিলি (৯০০-১০০০)
আম্মার ইবনে আলি আল-মাওসিলি হচ্ছেন আরেকজন বিখ্যাত আরব চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ আবিষ্কার করেছিলেন, যা ওষুধের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। বিশেষত, ছানি অস্ত্রোপচারে তিনি অন্যান্য অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত না করে কীভাবে একটি ফাঁপা সুই ব্যবহার করতে হয় তা প্রবর্তন করেছিলেন।
ফাতেমীয় খলিফা আল-হাকিম বি-আমর আল্লাহর শাসনামলে, তিনি কিতাব আল-মুন্তাখাব ফি ইলম আল-আইন গ্রন্থটি রচনা করেন।
আল-হাসান ইবন আল-হাইথাম (৩৫৪-৪৩০)
আধুনিক আলোকবিদ্যার জনক হিসেবে পরিচিত আল-হাসান ইবনে আল-হাইথাম আলোকবিজ্ঞানের বই (কিতাব আল-মানাজির) লিখেছিলেন, যা আলো এবং দৃষ্টির বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক প্রকাশ করে। বইটির একটি ল্যাটিন অনুবাদও রয়েছে (De Aspectibus)। তার ধারণা ইউরোপীয় রেনেসাঁ সহ ইউরোপীয় পণ্ডিতদের প্রভাবিত করেছিল। তিনি পশ্চিমে “আলহাজেন” নামে পরিচিত এবং তার গবেষণা ইউরোপীয় রেনেসাঁর পণ্ডিতদের উপর দারুণ প্রভাব ফেলেছিল।
“আধুনিক আলোকবিদ্যার জনক” হিসাবে পরিচিত, ‘বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি’ সম্পর্কেও তার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। অর্থাৎ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অনুমান পরীক্ষা করা।
আল-বাত্তানি (৮৫৮ – ৯২৯)
আল-বাত্তানি আলবাতেনিয়াস নামেও পরিচিত। তিনি শুধু একজন মহান আরব গণিতবিদই ছিলেন, না বরং একজন বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদও ছিলেন। তিনি ত্রিকোণমিতিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন যা একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করে। উদাহরণস্বরূপ, সমকোণী ত্রিভুজের জন্য, তিনি b \sin(A) = a \sin(90° – A)bsin(A)=asin(90°−A) সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। .
তার অনেক অবদানের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ৪৮৯টি তারার ক্যাটালগ তৈরি করা, এবং বছরের দৈর্ঘ্য এবং ঋতু পরিবর্তন বোঝার জন্য জন্য বিদ্যমান পদ্ধতির মান উন্নত করা।
ইবনে আল-বায়তার (১১৯৭-১২৪৮)
ইবনে আল-বায়তার একজন জনপ্রিয় ফার্মাসিস্ট এবং উদ্ভিদবিদ ছিলেন। তিনি স্পেনে তার প্রথম কর্মজীবন শেষ করেছিলেন এবং পরে উত্তর আফ্রিকার উপকূল জুড়ে ভ্রমণ করেছিলেন। ভ্রমণকালে তিনি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য বিভিন্ন ভেষজ সংগ্রহ করেন।
ইবন আল-বায়তার মিশরের গভর্নরের প্রধান ভেষজবিদও হয়েছিলেন। তিনি কিতাব আল-জামি ফি আল-আদউইয়া আল-মুফরাদা বইটি লিখেছেন, যেখানে চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য ১৪০০টি উদ্ভিদের উল্লেখ রয়েছে। ইবনুল বায়তারের অন্য বই, কিতাব আল-মলঘনি ফি আল-আদ্বিয়া আলমুফরাদা, বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় বিভিন্ন ওষুধের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করেছে।
জাবির ইবনে হাইয়ান (৭২১-৮১৫)
আবু মুসা জাবির ইবনে হাইয়ান আল-আজদি, আল-হাররানি এবং আল-সুফী নামেও পরিচিত। পশ্চিমা বিশ্বে তিনি গেবার নামেও পরিচিত। তিনি আরব রসায়ন এবং আধুনিক ফার্মেসির প্রতিষ্ঠাতা।
তিনি দর্শনের উপর প্রায় তিনশত বই, যান্ত্রিক যন্ত্রের ওপর হাজার তিনশত বই এবং রসায়নের উপর শত শত বই লিখেছেন। সে সকল বিজ্ঞানী সর্বপ্রথম নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাসায়নিক পদার্থের শ্রেণিবিন্যাস করেন, তিনি তাদেরও একজন।
আবু বকর আল-রাজি (৮৬৫-৯৩৫)
আবু বকর আল-রাজি ছিলেন একজন পার্সিয়ান চিকিৎসক এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানী। তার উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার ছিল গুটিবসন্ত এবং হামকে আলাদা করা, যদিও সেই সময়ের লোকেরা এই দুটো রোগকে একই বলে মনে করত।
তিনি শিশুরোগ নিয়ে প্রথম বইও লিখেছেন। জাদু বা কুসংস্কারের পরিবর্তে অভিজ্ঞতামূলক প্রমাণে তার দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে সাথে, তার অনেক ছাত্রও ছিল যাদের তিনি রোগীদের কীভাবে চিকিত্সা করতে হয় তা শিখিয়েছিলেন।
সবচেয়ে বিখ্যাত মহিলা মুসলিম বিজ্ঞানী
যখন আমরা মহিলা মুসলিম বিজ্ঞানীদের কথা বলি, তখন আমাদের অবশ্যই ডক্টর রানা দাজানির কথা উল্লেখ করতে হবে। তিনি একজন ফিলিস্তিনি-জর্ডানীয় আণবিক জীববিজ্ঞানী, যিনি ‘বিশ্বের ১০০ সবচেয়ে শক্তিশালী আরব মহিলা’ তালিকার শীর্ষ ১৫ জনের মধ্যে রয়েছেন। তার গবেষণা কাজ জেনেটিক্স, আণবিক জীববিজ্ঞান এবং স্টেম কোষের উপর।
পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ইতিহাসে মুসলিম বিজ্ঞানীদের এমন অসামান্য অবদান থাকার পরেও, পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে মুসলিম সমাজের বৃহৎ অংশ নিজেরাই এই মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান সম্পর্কে অবগত নয়। মুসলিম জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনার জন্য প্রথম ধাপ হওয়া উচিত নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে ভালোমত জানা, এবং কিংবদন্তি মুসলিম বিজ্ঞানীদের কাজ নিয়ে আরও গবেষণা এবং পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া।