Uncategorized
সবথেকে জনপ্রিয় ৭টি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি 

সবথেকে জনপ্রিয় ৭টি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি 

টানা বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ লোডশেডিং ভুলতে বসেছিলো। তবে ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট, তার সাথে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়। এর ফলস্বরূপ আবারো নতুন করে লোডশেডিং-এর উপদ্রব দেখা দিয়েছে। বিদ্যুতের চাহিদা কমিয়ে আনা লোডশেডিং থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি উপায় হতে পারে, যার জন্য দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তির বৃদ্ধি আবশ্যক। শুধু লোডশেডিং থেকে বাঁচতেই নয়, একবিংশ শতাব্দীর সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি জরুরি। 

বিশ্বের অনেক দেশেই বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তির ব্যবহার বিগত কয়েক বছরে অনেক বেড়েছে। উন্নত বিশ্বে, যেখানে কিনা লোডশেডিং হয় না বললেই চলে, সেখানেই বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তির বহুল প্রচলন দেখা যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এর কারণ হচ্ছে, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি যে কেবল জীবন যাত্রার মানই উন্নয়ন করে তা নয়, পরিবেশ রক্ষায়ও অবদান রাখে। আজকে এমনই কিছু বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করবো। এর মধ্যে কিছু প্রযুক্তি ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে রয়েছে! 

এলইডি লাইট 

led-light

বছর বিশেক আগেও ফ্লুরোসেন্ট লাইট ছিলো বিশ্বব্যাপী বহুল প্রচলিত। বর্তমানে ফ্লুরোসেন্ট লাইটের ব্যবহার অনেকটাই কমে এসেছে, কারণ এলইডি লাইট ফ্লুরোসেন্ট লাইটের থেকে চার থেকে ছয় গুণ বেশি বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে থাকে। এলইডি লাইট যে শুধু বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে তাই নয়, বরঞ্চ ফ্লুরোসেন্ট লাইটের থেকে অনেক বেশি টেকসইও হয়ে থাকে। 

led light vs. other lights
সাধারণ লাইটের তুলনায় কয়েকগুণ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে এলইডি লাইট

বর্তমানে বাংলাদেশে ফ্লুরোসেন্ট লাইটের স্থান দখল করে নিয়েছে এলইডি লাইট। বিভিন্ন পরিচিত ব্রান্ড এর বাইরে অনেক নন-ব্র্যান্ডেড এলইডি লাইট দেখা যাচ্ছে বাজারে। এর বিশাল একটা অংশ উৎপাদন হয় ঢাকার গুলিস্তান এলাকায়। দেশে উৎপাদিত সস্তা এলইডি লাইটের মান খুব একটা ভালো না হলেও তা দেশীয় বাজারের চাহিদা বেশ ভালোভাবেই মিটিয়ে আসছে। 

ইনভার্টার এসি 

interver ac

গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ট হয়ে অনেকেই চিন্তা করেন বাসায় একটা এসি লাগানোর। কিন্তু অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচের ভয়ে অনেক এসি কেনার সিদ্ধান্ত থেকে পিছপা হন। হালের ইনভার্টার এসি এই সমস্যার দারুণ এক সমাধান। ক্ষেত্র বিশেষে সাধারণ এসির থেকে ইনভার্টার এসি ৩০-৫০ ভাগ কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। 

inverter vs non-inverter ac
ক্ষেত্রবিশেষে ৫৮% বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে থাকে ইনভার্টার এসি

ইনভার্টার এসি প্রথমে পুর্ণ শক্তিতে চালু হয়, এরপর আপনার পছন্দমত তাপমাত্রায় আসার পর শক্তি খরচ কমিয়ে নিয়ে আসে। সাধারণ এসির মত বাতাস নিয়ন্ত্রণ করে বার বার অন-অফ হয় না ইনভার্টার এসি, যে কারণে বিদ্যুৎ খরচ অনেক কমে যায়। ইনভার্টার এসির বিশেষ সেন্সর ঘরের তাপমাত্রা বুঝে নিয়ে মোটর চলার গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কম্প্রেসর পুরোপুরি বন্ধ না করেই। 

স্মার্ট মোশন সেন্সর 

smart motion sensor

বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে বিদ্যুৎ অপচয়। অনেক সময়ই আমরা রুমের লাইট, ফ্যান চালু রেখেই অন্য কোথাও চলে যাই, আর বিনা কারণে বিদ্যুৎ খরচ হতে থাকে। এই ধরনের বিদ্যুৎ অপচয় রুখে দিতে স্মার্ট মোশন সেন্সর খুবই কার্যকরি। 

বাড়িতে স্মার্ট মোশন সেন্সর লাগানো থাকলে মনের ভুলে লাইট কিংবা ফ্যান চালু রেখে অন্য কোথাও চলে গেলে সমস্যা নেই। এই প্রযুক্তি ঘরের ভেতরে নড়াচড়া সনাক্ত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাইট কিংবা ফ্যান চালু-বন্ধ করতে পারে। যখন আপনি ঘরের ভেতর থাকবেন না, তখন নিজে থেকেই লাইট-ফ্যান বন্ধ হয়ে যাবে। 

এই প্রযুক্তি এখনও বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত হয়নি। বিভিন্ন অভিজাত এলাকার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে এই প্রযুক্তি দেখা যায়। 

রিফ্লেক্টিভ রুফিং 

reflective roofing

এই প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। রিফ্লেক্টিভ রুফিং প্রযুক্তির মাধ্যমে গোটা বাড়ির তাপমাত্রা কমানো সম্ভব। রিফ্লেক্টিভ রুফিং এমন একটি প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে বাসার ছাদে বিশেষ ধরনের কোটিং (coating) দেয়া হয়। এই কোটিং এ এমন পদার্থ থাকে, যা কিনা আলো প্রতিফলনকারী পিগমেন্ট যুক্ত। এর ফলে বাসার ছাদ গরমকালেও খুব একটা উত্তপ্ত হয় না। 

রিফ্লেক্টিভ রুফিং এর অনেক ধরনের সুবিধা রয়েছে। রিফ্লেক্টিভ রুফিং এর কারণে উঁচু বিল্ডিঙয়ের টপ ফ্লোরে থাকা বাসিন্দাদের প্রচণ্ড গরম সহ্য করতে হয় না। এছাড়া, গোটা বিল্ডিঙয়ের তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম থাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক কম বিদ্যুৎ খরচ হয়। এভাবে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়ে থাকে। তবে এই প্রযুক্তির ব্যবহারও আমাদের দেশে খুব একটা দেখা যায় না। ছাদের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য জলছাদ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 

ম্যাগনেটিক ফ্রিজ 

magnetic fridge

রেফ্রিজারেটর একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় হোম এপ্লায়েন্স। কিন্তু এরই সাথে রেফ্রিজারেটর সব থেকে বেশি বিদ্যুৎ খরচ করা এপ্লায়েন্সগুলোর মধ্যে অন্যতম। তবে বর্তমানে নতুন প্রযুক্তির বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ম্যাগনেটিক ফ্রিজ বেশ জন্যপ্রিয়তা পাচ্ছে বিশ্বজুড়েই। ম্যাগনেটিক ফ্রিজে সাধারণ ফ্রিজের থেকে একদমই ভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 

সাধারণ ফ্রিজে পুরনো ভ্যাপর কম্প্রেশন প্রযুক্তি ব্যবহার হয়। সাধারণ কুলিঙ সিস্টেমে তাপ নির্গমণকারী পদার্থ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই এ সকল পদার্থ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর (যেমনঃ সোডিয়াম-পটাশিয়াম এলয়) হয়ে থাকে।

ম্যাগনেটিক ফ্রিজে রয়েছে আধুনিক ম্যাগনেটোক্যালরিক প্রযুক্তি। এই ফ্রিজের ভেতরের তাপমাত্রা কম রাখা হয় ম্যাগনেটিক ফিল্ডের মাধ্যমে। এর সাথে সাথে শীতলক তরল হিসেবে ব্যবহৃত হয় পানি, যা কিনা পরিবেশের জন্য একদমই ক্ষতিকর নয়। ম্যাগনেটিক ফিল্ডের মাধ্যমে তাপমাত্রা কমানোর ফলে সাধারাণ ফ্রিজের কম্প্রেসরের মত অধিক বিদ্যুৎ খরচও হয় না। 

স্মার্ট পাওয়ার বোর্ড 

smart power board

স্মার্ট পাওয়ার বোর্ড রীতিমত একটি যুগান্তকারী প্রযুক্তি। আমরা বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতিতে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে থাকি পাওয়ার বোর্ডের মাধ্যমে। স্মার্ট পাওয়ার বোর্ড কোন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রে ঠিক যতটুকু বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়, ঠিক ততটুকুই সাপ্লাই দিয়ে থাকে। এতে করে বিদ্যুৎ অপচয় অনেক কমে আসে। 

ধরা যাক কোন একটি স্মার্টফোন ফাস্ট চার্জার দিয়ে চার্জ হচ্ছে। কুইক চার্জিং প্রযুক্তি সম্বলিত স্মার্টফোন শুরুতে অনেক দ্রুত চার্জ নিলেও কিছুক্ষণ পর চার্জের গতি কমে আসে। এতে করে ফোনের ব্যাটারি দীর্ঘস্থায়ী হয়। স্মার্ট পাওয়ার বোর্ড থাকলে চার্জের গতি কমে গেলে বিদ্যুতের সাপ্লাইও কমিয়ে দেয়। বাংলাদেশে এখনো সব বাসাবাড়িতে এই প্রযুক্তির ব্যবহার নেই। 

সৌরবিদ্যুত 

solar energy

সৌরবিদ্যুতকে ঠিক বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি বলা যায় না, কারণ এটি মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রযুক্তি। কিন্তু তারপরও, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সৌরবিদ্যুত হতে পারে ভবিষ্যতের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের সবথেকে কার্যকরী উপায়। সূর্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই প্রযুক্তি বাংলাদেশে এরমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়। গ্রামে-গঞ্জের বিভিন্ন বাড়িতে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি শহরাঞ্চলের বহুতল বিল্ডিঙের ছাদেও সৌরবিদ্যুতের প্যানেল লাগানো জনপ্রিয়তা পেয়েছে। 

সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা গত কয়েক বছরে অনেক বেড়েছে বাংলাদেশে

কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার অত একটা দেখা যায় না। সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে আসলে আশা করা যায় যে বাণিজ্যিকভাবে এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে।   

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি প্রচলনের চ্যালেঞ্জ 

বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ, এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর চাপ কমানোর লক্ষ্যে পুরো বিশ্বই চেষ্টা করছে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তির ব্যববার বাড়ানোর জন্য। বাংলাদেশে এই প্রযুক্তির বহুল প্রচলনের জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। 

সুষ্ঠু পরিকল্পনা 

বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তির বহুল প্রচলনের জন্য প্রথমেই দরকার সদিচ্ছা আর পরিকল্পনা। এ কথা সবাই জানে যে, অপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য অনেক শহর কিংবা এলাকাতে চাইলেই নতুন প্রযুক্তি আনা যায় না। এখন থেকেই পরিকল্পনা করে নতুন গড়ে ওঠা শহরগুলোয় শুরু থেকেই বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তির পরিকল্পনা করা উচিত। 

সচেতনতা 

শুধুমাত্র পরিকল্পনা করলেই হবে না, এর সাথে সাথে জনসচেতনতা প্রয়োজন আছে। একজন বাড়ির মালিক মনে করতেই পারেন যে রিফ্লেক্টিভ রুফিং করলে নির্মান খরচ বেড়ে যাবে, তাই সাধারণ রুফিং করাই ভালো। কিন্তু তিনি এই তথ্য না জানতে পারেন যে রিফ্লেক্টিভ রুফিং বছরের পর বছর ধরে বিদ্যুৎ খরচ সাশ্রয় করে যাবে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তির প্রচলনের জন্য তাই জনসচেতনতা খুবই জরুরী। 

বাজেট 

সাধারণ প্রযুক্তির থেকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি কিছুটা দামী হয়ে থাকে। এ কারণে অনেকেই এই প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে দূরে থাকেন। সরকার থেকে প্রনোদনা দিয়ে, কিংবা সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি জনপ্রিয় করা সম্ভব। 

আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে, এবং বৈশ্বিক পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবেলায় বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তির বহুল প্রচলনের কোন বিকল্প নেই। সরকার, বিভিন্ন এনজিও, পরিবেশবাদী সংগঠন, এবং সাধারণ জনগণ, এই সকল পক্ষেরই বিভিন্ন ভূমিকার মাধ্যমে এর বাস্তবায়ন সম্ভব।